আজ মহালয়া। দেবী পক্ষের সূচনা। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে মহিষাসুরমর্দিনী শুনে জেগে উঠলো ধ্বরা। মহালয়া মানেই বীরেন্দ্র কৃষ্ণ। ওনাকে ছাড়া মহালয়া যেন কল্পনাই করা যায় না। ছোটবেলায় রেডিওতে শুনতাম, এখন শুনি ইউটিউব অথবা এলেক্সা তে। আজ তো আবার আমি vijayawada তে বসে বিজ্ঞানের দৌলতে ব্যাঙ্গালোর বাড়ীর এলেক্সা চালিয়ে দিলাম। কিন্তু তবুও যেন মনে হয় রেডিও টা বেশী রোমান্টিক। সকাল চারটায় বাবা রেডিও চালিয়ে দিতেন, হাড়ভাঙা শীতে স্নান শেষ করে সবাই মিলে তাই শুনতাম আর মা রকমারি খাওয়া তৈরী করতে ব্যস্ত হয়ে পরতো সেই সাত সকালে। সেইসময় খুব ঠান্ডা পরত লামডিং এ। আমাদের বাড়ির সামনে একটা শিউলি গাছ ছিল। কাঁচা ঘাসের উপর কুয়াশা আর শুভ্র শিউলি ফুল একটা সাদা চাদরের আস্তরণ তৈরী করে আমাদের যেন হাতছানি দিয়ে ডাকতো।
আমাদের বাড়ির কাছেই ছিলো কালীবাড়ি যেখানে লামডিং এর সবথেকে বড় এবং প্রসিদ্ধ পূজো হতো এবং এখনো হয়। আমরা বন্ধুরা মিলে সেখানে বেশ একটা আড্ডা জমাতাম । তারপর যেতাম দাদুর বাড়ী । বেশীরভাগ সময় মহালয়ার মধ্যাহ্নভোজ টা ওখানেই হতো। মেজোমাসির (মাসীমনি) খুব প্রিয় ছিলাম আমি। পুজোর সবচাইতে বেশি কাপড় মাসী ই আমাকে দিতো। এই মাসী আমার কাছে ছিলো কল্পতরু। যা বাবা মা দিতে রাজি হতো না, এক আবদারে মাসী দিয়ে দিতো। কখনো মনে হয় কিছুই তো করতে পারলাম না মাসির জন্য; অসময়ে হটাৎ করে চলে গেলো।
সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই যান্ত্রিক প্রভাবে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। আজকাল সেই বন্দুক নিয়ে ছোটদের পাগল হতে দেখি না, কে কটা পুজো দেখেছে সেটা নিয়ে হই হট্টগোল করতে দেখি না। খুব বস্তুবাদী হয়ে গেছে সবাই। তখন যেমন নতুন কাপড়ের জন্য জন্য বায়না ধরতাম, আজ ভিডিও গেম এর জন্য বেশি উৎসাহ; আর করোনা র প্রভাবে অনলাইন ক্লাস আর তার দৌলতে ট্যাব আর ল্যাপটপ হাতে আসার একটাই লাভ – লোভনীয় জিনিস ছোটদের আমাজন ফ্লিপকার্ট এ উইসলিস্ট এ সংযোজন করা তো এখন ছেলেখেলা। তবুও যদি কিছুটা দেখা যায় সেই উত্তেজনা, সেই প্রাণ সেই উৎসাহ কোথাও যেন হারিয়ে গেছে। বিজয়ার পর একশো আট বার “শ্রী শ্রী মা দুর্গাঐ নম:” লেখা, শান্তি জল নিয়ে গুরুজনদের প্রণাম করা, যারা অন্য শহরে থাকেন, চিঠি লিখে তাঁদের প্রণাম জানানোর এই প্রথাগুলো যেন আমাদের অজান্তেই লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আর sms অথবা whatsapp এ বার্তা পাঠিয়ে সেই প্রথা সম্পন্ন করছি আমরা।
কখনো মনে হয় দোষ কিছুটা আমাদেরই যে আমরা সেই ঐতিহ্য গুলো ঠিকমতো বহন করতে পারছি না, আবার কখনো মনে হয় এটাই হয়তো স্বাভাবিক, এই পরিবর্তন হয়তো এই যুগের আহ্বান। কিন্তু বড় কষ্ট হয় নিজেকে মানাতে এ ধরণের পরিবর্তনের সাথে । কিন্তু মানাতে তো হবে যেমন করে দেবী দুর্গা মানিয়েছেন। যেমন আজ থেকে কুড়ি বছর আগে মা দুর্গা স্বপ্নেও ভাবেন নি যে ওনার সোনার প্রতীমা হবে কিন্তু বেশ সুন্দর মানিয়ে নিয়েছেন নিজেকে নতুন যুগের সাথে, তেমন করে আমাদের ও মানাতে হবে নতুন যুগের নতুন আবর্তনের সাথে। কিছু শূন্যতা তো থাকবেই, কিছু অনুভূতি নিরন্তর পেছন থেকে টানবে, কিছু ফেলে আসা স্মৃতি, কিছু সংস্কার বারংবার মাথাচাড়া দিয়ে কি ঠিক কি ভুল নিয়ে আমাদের মস্তিষ্কে একটা রোমন্থন করবে। কিন্তু আমাদের কিছুটা উপেক্ষা করে, কিছুটা মানিয়ে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে । এটাই পরিবর্তন, এটাই বর্তমান, এটাই প্রজন্মের ব্যবধান।
|| শুভ মহালয়া ||
***************************************************************